ভালবাসার পনের শ' সেকেন্ড (সম্পুর্ণ গল্প ) RoseGood Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ৩০ আগস্ট, ২০১৪, ০৫:৫০:২৫ বিকাল



Rose১ম পর্ব

সিনেমা হলটি নবীনগর থেকে ঢাকা যেতে রাস্তার বামে পড়েছে।

'সেনা অডিটোরিয়াম'। বিশাল ডিসপ্লেতে ছবির নাম আর অভিনেতা-অভিনেত্রীর বিশাল ছবি দেখা যাচ্ছে। ছবির নাম 'চোরের রাণী'। আর 'আসিতেছে' শীর্ষক পোষ্টারে আছে ' ডেয়ারিং লাভার'।

সবে ছ'টার শো দেড় ঘন্টা মত শেষ হয়েছে। এখন সাড়ে সাত বাজে। শো শেষ হতে এখনো এক ঘন্টা বাকি। সিনেমা হলটির সাথেই একটি রেস্তোরা রয়েছে। একবার ভাবে সেখানে কি ঢু মেরে দেখবে নাকি? যদি কাউকে পাওয়া যায়। ভালবাসার অন্তত একজন মানুষ খুবই দরকার ওর।

ও হল...

কি পরিচয় দেবে নিজের? মানুষ বললেই হবে, না কি তাঁর বুকের সামনের স্ফীত অংশ দুটো থাকায় মেয়ে মানুষ বলবে? তাতেও তাঁর পরিচয় সম্পুর্ণ হবে না। তবে থাক। আচ্ছা নাম বলবে কি... নাম তো কতগুলোই হয়েছে ওর। কোনটা বলবে? রেখা, ময়না, কাজল নাকি শিরিন? নামের বড়াই করো নাকো নাম দিয়ে কি হয়, নামের মাঝে পাবে নাকো সবার পরিচয়।

চিকন লাল পাড়ের সাদা শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা ব্লাউজ। হাতের লাল চুড়ির সাথে ম্যাচ করা টিপ... ঠোটটি ও রক্ত লাল। হাঁটার সাথে সাথে চুড়ির ঝনঝন শব্দে পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। আকর্ষণ করার জন্যই তো এগুলো পড়া। তবে ওর কমনীয় মুখে জোড়া ভ্রু'র নীচে কাজল দেয়া কালো চোখ... সেখানে দর্শকের প্রতি যদি শুধু মাত্র মদির আহ্বানটুকু না থাকত- তবে এক পাশে ছেড়ে দেয়া এলো চুলে এখন ওকে যা লাগছে, তা যে কোনো পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে যথেষ্ট।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে নবীনগর বাস-কাউন্টারগুলোর দিকে হেঁটে যেতে থাকে মেয়েটি। ওভার ব্রীজের আশেপাশে প্রায়ই ভালবাসার মানুষ পাওয়া যায়। যারা টাকা দিয়ে ওর কাছ থেকে ভালোবাসা কিনে নেয়।

হ্যা, সে একজন বারবনিতা!

লেখকদের বইয়ে মানুষভেদে ওদের নামও ভিন্ন হয়ে থাকে। সে পতিতা থেকে শুরু করে দেহপসারিনী, বেশ্যা, মক্ষীরানী ইত্যাদি নামে ভূষিত হয়। তবে ছেলে-ছোকড়ারা নিজেদের ভিতর কথা বলার সময় এমন একটি শব্দে ওকে সম্বোধন করে, তখন নিজের কাছে খুবই খারাপ লাগে। জগতের সব চেয়ে মধুর শব্দটির সাথে আর একটি বর্ণ লাগিয়ে সেকি হৃদয়চেরা অনুভূতি এনে দেয় ওরা!

ওভারব্রীজের ফুটপাতের ফলের দোকানের সামনে দাঁড়াতে হল বেশ খানিকটা সময়। অনেকগুলো অনুসন্ধানী চোখ ওকে দেখে গেলো... ওর সারাটা দেহকে চাটলো মনে হল ওর কাছে। এখন এসব অভ্যেস হয়ে গেছে। তারপরও নিজের ভিতরে কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি... একটু রুচিবোধের লঙ্ঘন সে টের পায়।

রুচিবোধ! তাও ওর মতো মেয়ে মানুষের? তাঁর আবার লঙ্ঘন? প্রচন্ড হাসি পায় ওর। একটু শব্দ করে হেসেও ফেলে। পাশ দিয়ে যাওয়া দুজন যুবক ওর হাসির শব্দে ওর দিকে তাকায়। প্রথমে একটু চমকায়... ফিরে যায় এবং দ্বিতীয়বার আবার তাকায়... এবং চিনে ফেলে।আসলে ওদেরকে সহজেই চিনে ফেলা যায়। প্রকৃতি-ই এই সহজে চিনিয়ে দেবার কাজটি করে থাকে। না হলে তো ওরা না খেয়ে মরে ভুত হতো এতোদিনে।ছেলেটি হেঁটে যেতে যেতে অন্যজনকে বলে, ' দ্যাখ, মাগি একা একা হাসে।' অন্যজন এটা শুনে খিক খিক করে হাসে এবং ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ' কি যাইবি নাকি?' তাঁরা থামে না। এক সাথে আরো মজার কিছু একটা বলতে বলতে চলে যায়।

ইচ্ছে করলে একটা প্রচন্ড খারাপ ভাষায় ছেলে দুটোকে গালি দিতে পারত... তাতে হয়ত মনের ভিতরে সৃষ্ট রাগ...ক্ষোভের সাময়িক উপশম হতো। কিন্তু দিন-রাত ২৪ ঘন্টা হৃদয়ে যে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে... সে এবং তাঁর মত আরো অনেক মেয়ে; তাঁদের এটা তো নিত্যকার পাওনা। সমাজের কাছ থেকে পাওয়া উপহার। গিফট ফ্রম দ্য সিভিল সোসাইটি। না হলে তাদেরকে ২ নাম্বার বলে উল্লেখ করত না কেউ। তাঁরা তো সভ্য সমাজের চোখে এ দেশের দ্বিতীয় সারির নাগরিক। যাদেরকে রাখা হয়েছে ১ম সারির মানুষের বিশেষ করে পুরুষদেরকে মনোরঞ্জন করার জন্য।

আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। ফিরে যাবে নাকি ভাবে একবার। কিন্তু টাকাও তো প্রয়োজন। হাত একেবারে খালি। ঘাটে ঘাটে দিতে হবে অনেক টাকা। টাকার ক্ষাক্কষের মতো একটা জটিল সিস্টেম ধাপে ধাপে হা করে আছে ওর... ওদের দিকে। ওর এভাবে ওপেন 'ভালবাসার মানুষ' খোঁজায় টাকা পেলে কেউই বাঁধা দেবে না। নবীনগর থেকে সেই শ্রীপুর সিনেমা হলটি পর্যন্ত ওর এরিয়া। এই দু'টি সিনেমা হল এবং তাঁর আশে পাশে ওরা চিহ্নিত কয়েকজন সেবাদাসী রয়েছে।

আচ্ছা ওদেরকে হেরেমের বাসিন্দা বললে কেমন হয়? রাজা-বাদশাহরা তো শুনেছে এভাবে হেরেমে যুবতী মেয়েদেরকে ভোগ করার জন্য রেখে দেয়। সেখানেও কি ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয় ওনাদের? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, ইস! যদি কোনোভাবে হেরেমের বাসিন্দা হতে পারত!! পরক্ষণেই ভাবে, 'আরে! আমার দেশটাই তো একটা প্রকান্ড হেরেম। যেখানে আমিও একজন সেবাদাসী... তবে আমি স্বাধীন। আর মরুর ওরা পরাধীন।'

এক ভ্রাম্যমান পান-সিগ্রেটওয়ালার কাছ থেকে জর্দা দিয়ে একটা পান কিনে। এই লোকটাও ওকে চেনে। টুকটাক কথা-বার্তা বলে। একটা সিগ্রেট টানবে কিনা ওকে জিজ্ঞেস করলে কৃত্তিম চোখ পাকিয়ে ওকে ভয় দেখায়। সে-ও ভয় পাবার মিথ্যে অভিনয় করে। এই সামান্য সময়ে দু'জন ভিন্ন পেশার মানুষের ভিতরের এই খুনসুটি টুকু আসলেই সুপার্ব! কারন এ যেন সম্পর্কহীনতার মাঝে সম্পর্কের পায়ে পায়ে কাছে আসা। কতগুলো মুখোশধারী মানুষের ভিতরে মুখোশহীন চিরচেনা অবয়ব! সবাই তো ওর কাছে আসে দেহটাকে খুবলে ছিন্ন-ভিন্ন করবে বলে। সেদিক থেকে পান-বিড়ি ওয়ালা নিম্নশ্রেনীর পশুর মত কাছে আসলেও সেখানে মমতা রয়েছে... রয়েছে নিজেদের ভিতরে একই শ্রেনীবোধ।

জাতীয় স্মৃতিসৌধের মেইন গেটের সামনে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। ওর পাশ দিয়ে ছেলে-মেয়েরা একে অপরের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। কি সুন্দরই না লাগছে দেখতে! মেয়েটির খোঁপায় গোঁজা ফুল... ছেলেটির হাতে কয়েকটি ব্রেসলেট। কি স্বাভাবিক ভাবেই না কথা বলছে, একজন অপরজনের চোখে চোখে তাকিয়ে হাসছে... দু'একটা কি কথায় যেন মেয়েটি হেসে গড়িয়ে ছেলেটির গায়ে পড়ছে।

খুব সুন্দর একটি দৃশ্য! সে অপলক চেয়ে থাকে... ওর দৃষ্টির সামনে দিয়ে দু'জনের সুখী জুটিটি অদৃশ্য হয়ে যায়... অনেকদূর পর্যন্ত সে চেয়ে থাকে। স্মৃতির পর্দায় নবীনগর বিস্মৃত হয়! স্মৃতিসৌধ... ওভারব্রীজ...সেনা অডিটোরিয়াম সব কিছু, এমনকি সে নিজেও হারিয়ে যায়। একটি গ্রাম দেখা দেয়... দুপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ নিয়ে ছোট্ট লম্বা একটি পায়ে চলা পথ! আকাশে কালো মেঘ! দু'পাশে বেনী করা চুল নিয়ে এক কিশোরির দ্রুত ছুটে চলা...এরপরের দৃশ্যগুলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসে... নিজের চোখের জল-ই যে এর জন্য দায়ী সেটা বুঝতে পারে না। সে যে এইমাত্র নিজেকেও বিস্মৃত হয়েছে!!

জাতীয় স্মৃতিসৌধের একেবারে প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে একজন বারবনিতা নিজের বিগত জীবনে ফিরে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাঁর চোখের জলে মুখের প্রসাধনী ধুয়ে মুছে যায়। সে পরিণত হয় এক সাধারন নারীতে। প্রতিটি বারবনিতা-ই তো প্রথমে একজন নারী। ধীরে ধীরে আমরা-ই তাঁকে পতিত এই সমাজে একজন পতিতা হয়ে উঠতে বাধ্য করি।

Rose২য় পর্ব

একটা প্রজাপতির পিছু ধেয়ে নিলু সোজা রাস্তাটা ফেলে ঝোপ-ঝাড়ে ঢাকা অব্যবহৃত পথে চলে এলো। এতো সুন্দর রঙ ! ডানাগুলো থেকে নিজের ভিতরে যদি সব রঙ নিতে পারত!! নিলুর কিশোরী মনে এই ইচ্ছেটা ডানা মেলে... এভাবে হঠাৎ হঠাৎ-ই ইচ্ছেরা ওকে ব্যতিব্যস্ত রাখে।

গ্রামের স্কুলের নয়টি ক্লাস অনেক কষ্টে সে পার করেছে। কষ্ট বলতে পড়ালেখার কষ্ট। সে চায় নীলাকাশের নীচে সাদা মেঘের ভেলায় মেঘবালিকা হয়ে ঘুরে বেড়াতে... ঘাস ফড়িঙ্গের হঠাৎ ছিটকে উঠা দেখে অভিভূত হতে... খালের বুক চিরে যে ছোট্ট শাখাটি ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে, তাঁর পাশের ঝোপ থেকে বৈচি না হয় ম্লান বেত ফল কোচর ভরে তুলে আনতে! খালের পানিতে ছাবি দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরে নারিকেলের শলায় গেঁথে পুড়িয়ে খেতে। এসবই ওর বড্ড পছন্দ। না হলে এক স্কুল মাস্টারের মেয়ে হয়েও পড়ালেখায় কেন এত কষ্ট লাগবে ওর?

বাবার সাথে স্কুলে দেখা হয়... আর ভোর বেলায় জোর করে ওকে ঘুম থেকে তোলার সময়। সেই সময় বাবাকে মেরেই ফেলতে ইচ্ছে হয়... কিন্তু খালি পায়ে বাবার সাথে ঘাসের বুকের জমাট শিশিরকে অনুভব করার সময়ে... বাবার জন্য পৃথিবীর সব ভালোবাসা এসে ভীড় করে ওর কিশোরি মনে! ওনার হাত ধরে সে হেঁটে যায় অনেকদূর... ইস! যদি মাইলের পর মাইল বাবার সাথে এভাবে হেঁটে যেতে পারত!

মা কে পায় দিনের বাকি সময়টাতে। সারাক্ষন ওকে চোখে চোখে রাখায় ব্যস্ত একজন মহিলা। আর পদে পদে কমপ্লেইন, 'নিলু এটা করিস না... এভাবে না... কেন করেছিস বল... ধিঙ্গি হচ্ছিস, বুদ্ধি শুদ্ধি কবে হবে বলতো... ... ...।' তবে সব কিছুর সাথে তাঁর অদৃশ্য এক হাসিমুখ থেকেই যেত। এক মায়ের মুখ... পৃথিবীর সব মায়ের মুখ! আর ঘরে-বাইরের সব কাজ শেষ হলে রাতে ওকে নিয়ে বসতেন। মাথার চুলে তেল দিয়ে চিরুনী বোলানোর ঘুম ঘুম আবেশ এনে দেয়া সেই মুহুর্তগুলো! কত রাত ওভাবে লুটিয়ে পড়েছে মায়ের কোলে। পরম মমতায় মা ওভাবেই রেখেছেন দীর্ঘক্ষণ। ভোর বেলায় বাবার ডাকে উঠবার সময়েও মায়ের মমতার আদিগন্ত বিস্তৃত বেড়াজাল সে অনুভব করেছে।

এই ভালবাসার নিগড়েই সে বড় হচ্ছিল... তিলে তিলে নিজের ভিতর থেকে আর একজনের জন্ম হচ্ছিল। একদিন নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করে চমকে উঠে। বাবা-মা'র জন্য হৃদয়ের অলিন্দগুলোতে সকল ভালোবাসা জমে আছে। ভালোলাগাগুলো তাদেরকে ঘিরেই ডানা মেলেছে। হঠাৎ এই দুজনের বাইরেও অন্য 'একজন' কীভাবে যেন সেখানে ভাগ বসাতে এলো। হেলাল নামের এই যুবকটি ওদের পাশের গ্রামের। তবে পারিবারিকভাবেই এলাকার সবাই সবাইকে চিনে। এভাবেই ওর সাথে দেখা হতো... ওদের বাড়ি স্কুলে যাবার পথে পড়ে। যাওয়া আসার সময়গুলোতে দুজনের দেখা হতো। মৃদু খুনসুটি করত ... বান্ধবীদেরকে সাথে নিয়ে কান গরম হয়ে যাওয়া মেয়েলি কথাবার্তাও হতো মাঝে মাঝে ... সব হেলালকে ঘিরে। তবে ছোট ছোট দুষ্টুমির আড়ালে প্রলয়ংকারি ভালোবাসাকে ঘিরে এক কূটিল সর্বনাশের পথও যে প্রসস্ত হচ্ছিল...

সময়ের সাথে সাথে বাবা-মা সব জেনে যায়। স্কুল মাস্টার বাবার ঠান্ডা মাথার চিন্তা-ভাবনা এই কিশোরি মেয়ের এহেন বালিকাসুলভ প্রগলভতায় রুষ্ট হয়। মা তাঁর মমতাকে আড়াল করেন... কঠিন হতে বাধ্য হন। তবে এসবই ছিল মেয়ের ভালোর জন্য। কিন্ত সময় পানিকে অনেকদূর গড়িয়ে নিয়েছিল। হেলালের জন্য নিলুফারের ভালোবাসা সাময়িকভাবে বাবা-মাকেও ছাড়িয়ে গেছিলো। রমণীর মন যদি সহস্র সাধনার ধন হয়, তবে এক কিশোরির মন বিনা সাধনায় পাওয়া যায়। আর এই সুযোগটি-ই নিয়েছিল হেলাল। ঘরে বাইরে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে অতিষ্ট নিলু একদিন হেলালের ভালবাসার টানে ওকে নিয়ে ঘর ছাড়ে।

আগে কক্ষনো নিলু ওদের গ্রাম ছেড়ে কোথায়ও যায়নি। জন্মের পর এই প্রথম বের হওয়া... নিজের ভালবাসার মানুষটির হাত ধরে পরম নির্ভরতায় চিরপরিচিত সেই মেঠো পথটি ধরে যাবার সময় কয়েকবার পিছু ফিরে চেয়েছিল। সেই মাঠ... ফড়িঙ বসার ঝোপ... প্রজাপতির রঙিন ডানা... বাঁশগাছের আড়াল... পুকুরপারের সেই উঁচু তালগাছ আর সেখানের বাবুইয়ের বাসাগুলো... এসব-ই ওকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। হয়তো এভাবে যেতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু একবার যে হাতকে সে শক্ত করে ধরেছে, সেই ভালবাসার হাতকে কীভাবে ছাড়ে?

হেলাল ওকে নিয়ে নদীর পাড়ে এক ঘিঞ্জি এলাকায় এলো। নিলু তখনো বুঝতে পারেনি, সে কোথায় এসেছে। হেলাল ওকে বলেছে যে এখানে ওর এক খালা থাকেন। সেখানে এক রাত থেকেই ওরা ঢাকা চলে যাবে। সরল বিশ্বাসে কিশোরি তা মেনে নিয়েছিল। হেলালের খালাকে দেখে নিলুর ভালো লাগল না। আরো কিছু মেয়েকে দেখতে পেল। সবাই কেমন মেকী রঙে রঙিন হয়ে ঘোরাফেরা করছে। একটা অশনিসংকেত ওর কচি বুকে টের পেলেও তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। একটা ছোট রুমে ওদের থাকার ব্যবস্থা করলেন হেলালের 'খালা'।

সেই রাতের কথা নিলুর আজীবন মনে থাকবে।

সেই রাত! এক কিশোরির নারী হয়ে ওঠার রাত! একজন নিলুর 'নীলায়' পরিণত হবার রাত।

হেলালের হাত ধরে ঘুমিয়ে ছিল সে। তবে কখন যে ভালবাসার মানুষটি সন্তর্পনে ওর পাশ থেকে সরে যায়... তাঁর যায়গায় অন্য একজন আসে... রাত্রীর অন্ধকার সেই কালো মানুষটির কদাকার চেহারা আর বিকৃত কামনার কদর্যতা নিলুর কাছ থেকে আড়াল করতে পারল না। হৃদয়ে ভালোবাসা নিয়ে প্রিয় মানুষটির সাথে মিলনের আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষারত এক কিশোরী মুহুর্তে একজন নারীতে পরিণত হয়... একজন দুই নাম্বার... একজন সেবাদাসী। আর ভালবাসার ফল্গুধারায় আজীবন সিক্ত হতে চেয়েছিল যে... সে অবাক বিষ্ময়ে অনুভব করে ভালবাসার পনের শ' সেকেন্ড!

এরপর রাতের পর রাত কেটেছে নীলা হয়ে... হেলাল নামের এক সময়ের প্রিয় মানুষটি ওকে বিক্রী করে চলে গেলো একটি পতিতালয়ে। একটি দমবদ্ধ ছোট কুঠরীতে। সেখানে এক রঙিন প্রজাপতি তাঁর ডানা হারিয়ে প্রতি রাতে মথেদের দ্বারা ধর্ষিত হতে থাকে। তবে প্রতিবার সে একটি সবুজ ঘাসের উপত্যকায় নিজেকে কল্পনা করে... সেখানে তাঁর হাত ধরে থাকে তাঁর ভালবাসার মানুষটি!

স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে এগুলোই ভাবছিল নীলা। হ্যা এখন আমরা তাঁর একটি নাম পেয়েছি। নীলা! সমাজের কাছে সে এখন নীলার মতই... অনেকের সহ্য হয় না এমন এক পাথর। চোখে পানির দাগ রয়ে গেছে গালে। সাথের ব্যাগ থেকে ছোট আয়না বের করে নিজেকে রমনীয় করার চেষ্টা করে। একটা গাড়ি এসে থামে পাশে। সেখান থেকে গ্লাস উঠিয়ে ওপাশ থেকে একজন ওর দিকে তাকায়। চোখে ইশারা করে... অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাঁকে সম্পুর্ণ উপেক্ষা করে। বিপরীত দিকে চলে যায়। আজ সে নীলা হবে না। কিছুটা সময় নিলু হয়ে দেখবে কেমন লাগে। পিছন থেকে সেই গাড়ির ভদ্রলোকটির তীর্যক কথা শুনে একটু থামে। সে বলে চলেছে, ' কত ঢং করছিস, তোদের মতো ...দের জন্যই তো দেশের আজ এই অবস্থা। সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে...'। কেন জানি নিলু থেকে মুহুর্তে নীলা হয়ে সেই মানুষটির সামনে ফিরে আসে। দুহাত কোমরে রেখে বলে, ' আমাদের জন্য সব ধ্বংস হচ্ছে , না? তো তুই কি করছিস এখানে? আরে আমরা তো পেটের জন্য এইগুলা করছি। আর তোদের মত ভদ্রলোকেদের বউরা গিয়ে দেখ, শুধু শুধু তোরই বিছানায় অন্য কারো সাথে... তুই যেমন আমার কাছে এসেছিস, টাকা দিয়ে ক্ষুধা মিটাবি, ওরা বিনা টাকায় অতৃপ্তি মিটাচ্ছে গিয়ে দেখ।'

গাড়ির ভদ্রলোকটি প্রচণ্ড ক্রোধে গাড়ি থেকে বের হয়। সে ভুলে যায় সে কি করছে। আশেপাশের কয়েকজন মজা দেখছে... দাঁত বের করে একে অপরের শরীরে আঙ্গুলের গুতা দিয়ে নীলা আর ভদ্রলোকটির দিকে ইশারা করছে। সেই মানুষটি ভুলে গেছে সে কোথায় এবং কার সাথে ঝগড়া করছে। একটা হাত প্রচণ্ড জিঘাংসায় নীলার গালের ওপর আছড়ে পড়ে। একবারই... থাপ্পরের শব্দে অন্য শব্দ চাপা পড়ে যায়। একজন নীলা স্মৃতিসৌধের এই যায়গা থেকে স্লো-মোশনে অতীতে ফিরে যায়... যুবতী থেকে কিশোরি... পতিতালয়ের দুঃসহ সেই দিনগুলোতে... সেখানের প্রথম রাত... হেলালের হাত ধরে গ্রামের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ফেলা দীর্ঘশ্বাস... বাবার হাত ধরে ঘাসের বুকে বিচরণ... মাথার চুলে তেল দেবার সময়ে আদরে মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়া... ফড়িঙ আর প্রজাপতির পিছু ধেয়ে ঝোপের ভিতরে প্রবেশ করা... সরু খালের পাড়ের বৈচি ফল আর বেত ফল কোঁচড় ভর্তি করে বাড়ি ফেরা... ... এখান থেকে আবার উল্টো ভাবে ধাপে ধাপে এই স্মৃতিসৌধে ব্যথায় গালে হাত দিয়ে ঘাড় একপাশে কাত হয়ে তীব্র দৃষ্টিতে সেই লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকা! সব কিছু মুহুর্তের ভিতরে ঘটে যায়। নিজের পায়ের স্যান্ডেল খুলে লোকটির গালে প্রচণ্ড এক আঘাত করে নীলা। এরপর একদম সহজ ভঙ্গীতে স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে জয় রেস্তোরাঁর দিকে রওয়ানা হয়।

রাস্তা পেরিয়ে রেস্তোরাঁর সামনে কিছু মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করে। সেদিকে এগিয়ে যায়। কয়েকজন ওর দিকে তাকায়। এদের ভিতর থেকেই হয়তো কেউ একজন ওর ভালবাসার মানুষ রয়েছে। যে ওকে নিয়ে যাবে নির্দিষ্ট কোনো যায়গায়। কেটে যাবে ভালবাসার পনের শ' সেকেন্ড... একজন নীলা তখন একজন নীলুতে অবগাহন করবে।

আমাদের আশেপাশে এরকম নীলুদের নীলা হয়ে উঠা আমরা কখনো কি অনুভব করি?

আমাদের কি কিছুই করনীয় নাই?

শুধু ঘৃনায় নাক কুঁচকে ওদের থেকে ফিরে তাকানো-ই কি সভ্যতা?

অথবা কিছু মুহুর্তে মানুষ থেকে পশুমানবে রুপান্তরেই কি আমাদের সফলতা?

আমি জানি না... তবে জানতে চাইছি, আমার কি করনীয়??

Good Luck Good Luck Good Luck

বিষয়: সাহিত্য

১৬৮৯ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

259733
৩০ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৯:০৬
নিউজ ওয়াচ লিখেছেন : দারুন্স। ছবিটা আর সন্দর Love Struck Love Struck Love Struck
৩১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:২০
203664
মামুন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ভাই।
হ্যা ছবিটা সুন্দর, আর বাস্তবের নিলু কিংবা নিলারাও মনের দিক থেকে অনেক সুন্দর। কিন্তু আমরা কেবল বাহ্যিক দিকটাকে দৃষ্টিতে এনে ওদের কদর্য রুপটি দেখে থাকি।
আপনার জন্য অনেক শুভেচ্ছা।
259745
৩০ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৯:৩৩
আতিক খান লিখেছেন : A true pic of our society, sad but practical story.Thanks.
৩১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:২১
203665
মামুন লিখেছেন : তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা রইলো।Happy Good Luck
259779
৩০ আগস্ট ২০১৪ রাত ১০:৫৫
হতভাগা লিখেছেন : ''নিজের পায়ের স্যান্ডেল খুলে লোকটির গালে প্রচণ্ড এক আঘাত করে নীলা। ''

০ সাবাস নীলা ! সাবাস নারী ! সাবাস কন্যা সাহসিকা ! খদ্দেরের ১৫০০ সেকেন্ড আর তোমার মাত্র ১৫ সেকেন্ড ! ওয়াও!

হ্যাঁ তোমাদেরকে দিয়েই হবে । তোমরাই পারবে দেশকে সবক দিতে । দেশকে এগিয়ে নিতে ।

এসব নীলারা সমাজকে কলুষিত হবার হাত থেকে রক্ষা করছে । এদের ঘরের মাটি দিয়েই আর ক'দিন পর মূর্তি বানিয়ে পুঁজো শুরু হবে ।

গার্মেন্ট কর্মীদের পোশাক যোদ্ধা বা সেলাই দিদি উপাধী দেওয়া হয়েছে । যৌন সেবা দেওয়াও তো একটা সেবা দেওয়া - এটারও সে রকম একটা সুন্দর নাম দেওয়া উচিত ।


৩১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:২৮
203671
মামুন লিখেছেন : " এসব নীলারা সমাজকে কলুষিত হবার হাত থেকে রক্ষা করছে । এদের ঘরের মাটি দিয়েই আর ক'দিন পর মূর্তি বানিয়ে পুঁজো শুরু হবে"- এই লাইনগুলো ঠিক বুঝলাম না ভাইয়া।
গল্পটি কিন্তু যৌনতাকে নিরুৎসাহিত করার জন্যই তুলে ধরা হয়েছে। একজন মেয়ে কীভাবে যৌনদাসী হয়ে উঠে, সমাজ কীভাবে তাঁকে তার অবস্থানে থেকে যেতে বাধ্য করে, প্রশাসন এই যৌনতাকে টাকার বিনিময়ে লালন করে, সর্বোপরি 'আমরা' নিজেদের বিকৃত কাম লালসাকে চরিতার্থ করতেই নিলুদেরকে নিলায় রুপান্তর করি- এগুলো কি অস্বীকার করা যাবে?
আসলে নিলাদেরকে সামাজিক ভাবে পুনর্বাসন দ্বারা ওদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এই কাজটি একটি 'কল্যাণমূলক রাষ্ট্র' হিসেবে রাষ্ট্রের যেমন করার কথা, তেমনিভাবে 'আমাদের'ও কিছু না কিছু করার প্রয়োজন। কিন্তু যখনি কোনো পতিতার নাম উচ্চারণ হয়, আমরা নিজেদের ভিতরকার ঘৃণায় নাক কুঁচকে ফেলি, ওদের নিয়ে কিছু করার চিন্তা তো দূরের কথা।
ধন্যবাদ আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য।Happy Good Luck Good Luck
259898
৩১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:১৬
কাহাফ লিখেছেন : নীলার আভরনে ঢেকে থাকা এই নীলু রা আমাদেরই অংশ,বোন-মা-আত্মীয়।অনেক কিছুই করতে পারি আমরা,এর জন্যে আমাদের কে এক হতে হবে- নেক হতে হবে।নীলুদের জন্যে শুভ কামনা...... Rose Rose Rose
৩১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:৩১
203674
মামুন লিখেছেন : হ্যা, নিজেদের মনের ঘৃণাকে যখন দূর করে নিলুদেরকে নিয়ে কিছুটা সময় দিতে পারবো, তখনই কিছু করা যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা তো সেখানেই, যখনি নিলুদেরকে নিয়ে করার জন্য এগিয়ে যাবে কেউ, সমাজই সর্বাগ্রে বাঁধা দিতে এগিয়ে আসবে।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck Good Luck
259907
৩১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৮:৪৬
কাহাফ লিখেছেন : ধর্মীয় ও মানবিকতায় বলিয়ান হয়ে এগিয়ে যেতে হবে,চেষ্টা ও দোয়ার মাধ্যমে সমাজ কে বদলে দিতে হবে। কাউকে না কাউকে এগিয়া আসতে হবেই এ ব্যাপারে....। আপনাকেও হাযাহকাল্লাহ..।
৩১ আগস্ট ২০১৪ দুপুর ০১:৪১
203783
মামুন লিখেছেন : সুন্দর বলেছেন। দেখা যাক, সামনে কি হয়।
আপনার সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি। ভালো থাকবেন।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File